ইতিহাস জানার উপায় এবং যুগ বিভাজন সমস্যা

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান - History & Social Science - | NCTB BOOK

ইতিহাস জানার উপায় এবং যুগ বিভাজন সমস্যা

এই শিখন অভিজ্ঞতাটি সাজানো হয়েছে 'ইতিহাস জানার উপায় এবং যুগ বিভাজন' এবং 'বাংলা অঞ্চল ও বাংলাদেশ: রাজনৈতিক ইতিহাসের বৈচিত্র্যময় গতিপথ' এই দুটি বিষয়কে নিয়ে। প্রথমে আমরা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা পাঠ করে নিজেদের মতামত দেব। সহপাঠীদের মধ্যে একই ঘটনার বিভিন্ন মতামত শনাক্ত করব। আমাদের বইতে প্রদত্ত ইতিহাস জানার উপায় জানব এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা-সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করব। বইতে দেওয়া যেকোনো একটি ঐতিহাসিক ঘটনা একাধিক উৎস যেমন: বই, পত্রিকা, টিভি বা রেডিও চ্যানেলের আর্কাইভ, ভিডিও, অনলাইন আর্টিকেল ইত্যাদি থেকে সংগ্রহ করব। বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যকে বিশ্লেষণ করে যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হব। এরপর নিজেদের এলাকার কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা বাছাই করে এলাকার পরিচিত কয়েকজনের কাছ থেকে মতামত এবং বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য নিয়ে সেই ঐতিহাসিক ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেবে। এরপর 'ইতিহাসের দলিল' নামে একটি সাময়িকী তৈরি করে সেখানে এলাকার ইতিহাস তুলে ধরব।

এখন আমরা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে জেনে নিই। ঘটনাটি হচ্ছে, শুভঙ্কর দাস নামে একজন গণিতবিদ সম্পর্কে। তার তৈরি করা মানসাঙ্ক কীভাবে ইংরেজ আমলে ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার আড়ালে হারিয়ে যায়। শুধু তা-ই নয় তাঁর নামে তৈরি প্রবাদ- 'শুভঙ্করের ফাঁকি' যুগ যুগ ধরে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। চলো, তাহলে আমরা জেনে নিই সে ঘটনাটি।

শুভঙ্কর কী আসলেই ফাঁকি দিয়েছিলেন? '

শুভঙ্করের ফাঁকি' বাগধারাটি দিয়ে প্রতারণা করা, ফাঁকি বা ধোঁকা দেয়া বোঝায়। এর অর্থ হলো 'হিসাব নিকাশের মারপ্যাঁচে আসল বিষয় রেখে কর্তৃপক্ষ বা সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে ফায়দা হাসিল করার কৌশল'। 

আমাদের অনেকের মনেই হয়তো প্রশ্ন জাগছে- কে এই শুভঙ্কর? তিনি কী এমন ফাঁকিবাজি কাজ করলেন? চলো এটার পেছনের ইতিহাসটা একটু জানা যাক। 

শুভঙ্কর ছিলেন একজন অসাধারণ গণিতবিদ। তিনি আর্যার (গণিত-সংক্রান্ত কতকগুলো বিধি) মাধ্যমে জটিল অঙ্কের সমাধান দিয়েছেন। আগে ক্যালকুলেটর ছিল না। তিনি মানসাঙ্ক বা মুখে মুখে বড়ো বড়ো অঙ্ক কষায় দক্ষ ছিলেন। 

১৮৫৫ সালে ইংরেজ শিক্ষাবিদ ও ধর্মপ্রচারক রেভারেন্ড জেমস লং এর বক্তব্য ছিল শুভঙ্করের ছন্দোবদ্ধ সূত্রে গাঁথা সাধারণ গাণিতিক নিয়মগুলো গত দেড়শ বছর ধরে প্রায় চল্লিশ হাজার বাংলা পাঠশালা মুখরিত করে রেখেছে। 

এত বড়ো মাপের একজন গণিতবিদকে নিয়ে তাহলে কারা এমন অপবাদ দিল? তা একটু পরেই আমরা জানতে পারব। তার আগে চলো শুভঙ্করের একটি আর্যা সম্পর্কে জেনে নিই।

সরোবরে বিকশিত কমল নিকর। 

মধুলোভে এল তথা অনেক ভ্রমর। 

প্রতি পদ্মে বসি ভ্রমর যুগল। 

অলিহীন রহে তবে একটি কমল। 

একেক ভ্রমর বসে প্রতিটি কমলে।

 বাকি রহে এক অলি, সংখ্যা দেহ বলে। 

এর অর্থ একটি জলাধারে কমল বা পদ্ম ফুল ফুটে আছে। সেখানে মধু সংগ্রহে কয়েকটি মৌমাছি বসল। প্রতিটি পদ্মে দুটি করে ভ্রমর বসল। এতে একটি পদ্ম ফাঁকা রইল। অন্যদিকে প্রতিটি পদ্মে একটি করে ভ্রমর বসলে বাকি একটি ভ্রমর ফাঁকা থাকে।

এই মানসাঙ্ক আধুনিক পদ্ধতিতে সমাধান করলে দাঁড়ায়: 

পদ্ম সংখ্যা X এবং ভ্রমর সংখ্যা Y হলে, 

Y=২(X-1)......(১) 

Y=x-১......... (২) 

(১) ও (২) নং সমাধান করে পাই, 

X=৩, Y=৪

অর্থাৎ সরোবরে ৩টি পদ্ম ও ৪টি ভ্রমর ছিল।

এভাবে তিনি ছন্দের তালে তালে গণিতের সমাধান করতেন। তাঁর লেখা 'ছত্রিশ কারখানা' নামক পুস্তকে দুই হাজারের মতো এরকম শ্লোক ছিল। এতে অনেক ফারসি শব্দও আছে। ১৭৫৭ অব্দে পলাশী যুদ্ধের আগেও বাংলার ছাত্ররা শুভঙ্করের আর্যা পড়ত বলে জানা যায়।

ইংরেজরা এই দেশ দখল করার পর ইংরেজি শিক্ষায় মোহগ্রস্ত শিক্ষিত ব্যক্তিগণ নিজ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। নিজেদের ভালো জিনিসকে বিসর্জন দিয়ে বলতে থাকেন- শুভঙ্কর ফাঁকি দিয়ে বা গোঁজামিল দিয়ে অঙ্ক মেলান। সেই থেকে প্রবাদ হয়- শুভঙ্করের ফাঁকি।

কয়েকশ বছর পরে এখন ঐতিহাসিক গবেষণায় ওঠে এসেছে তাঁর অসাধারণ মেধা এবং বাংলার গণিতে তাঁর অবদানের কথা। ঢাকা ও কলকাতার বেশ কয়েকটি পত্রিকায় এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। (সংগৃহীত, মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান, অ্যাসোসিয়েট ফেলো, রয়েল হিস্টোরিক্যাল সোসাইটি, মানবজমিন, ঈদসংখ্যা, ২০২৩)

অনুশীলনী কাজ ১

এখন আমরা উপরের ঘটনা সম্পর্কে নিজেদের মতামত লিখি। মতামত লেখা শেষ হয়ে গেলে নিজের মতামত বলি এবং সহপাঠীদের লেখা মতামত শুনি। এরপর নিজের মতামতের সঙ্গে সহপাঠীদের মতামতের মিল ও অমিল খুঁজি।

আমরা খেয়াল করলে দেখব একই ঘটনা আমরা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে মতামত দিচ্ছি। তাছাড়া সত্যিকার ইতিহাস জানার জন্য লোকমুখে প্রচলিত কথার উপর নির্ভর করলে হয় না। বিভিন্ন লিখিত উৎস যেমন: দলিল, দস্তাবেজ, বিভিন্ন ঐতিহাসিক বই, পত্রিকা ইত্যাদি থেকেও তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। প্রকৃত ইতিহাস বর্ণনা বা ঘটনা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য কিছু বিষয় লক্ষ্য রাখতে হয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য নিচের অংশটুকু পড়ে নিই।

ইতিহাস পাঠ ও অনুসন্ধান মানুষের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আনন্দের বিষয়। ইতিহাসের পাঠ মানুষের অতীত অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ এবং যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সহায়তা করে। অতীত না জানলে মানুষের কোনো বর্তমান থাকে না। আর মানুষের ভবিষ্যৎ তার অতীত কর্মকাণ্ডের উপর নির্ভর করে। সুতরাং অতীতে মানুষের অর্জিত নানান অভিজ্ঞতার বিজ্ঞানসম্মত এবং গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত সকল মানুষ, সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য অতীব জরুরি ও তাৎপর্যপূর্ণ। এই যে হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের পূর্বসূরিরা এই পৃথিবীতে নানান চ্যালেঞ্জ বা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে টিকে ছিলেন, তাঁদের সেইসব অভিজ্ঞতা, নানান কাজকর্ম বা জীবনধারার ধারাবাহিক বর্ণনা যখন নির্ভরযোগ্য উৎস ও প্রমাণের ভিত্তিতে যৌক্তিক ও বিজ্ঞানসম্মতভাবে জানা ও বোঝার চেষ্টা করা হয়, তখনই তা ইতিহাস হয়ে ওঠে।

মানুষ লক্ষ বছর ধরে কীভাবে পৃথিবীর বুকে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে, কৃষি ও নগর বিপ্লব ঘটিয়েছে, ভাষা-সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্ম উদ্ভাবন করেছে, রাজ্য-রাষ্ট্র নির্মাণ করে বর্তমানে এসে পৌঁছেছে তার ইতিহাস নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুসন্ধান করে জানা প্রয়োজন। আর এই ইতিহাস যিনি নিয়ম মেনে অনুসন্ধান করবেন তিনি হলেন ইতিহাসবিদ। একজন পেশাদার ইতিহাসবিদ ইতিহাস অনুসন্ধানের নিয়মতান্ত্রিক কলাকৌশল ও পদ্ধতিগুলো নির্মোহভাবে প্রয়োগ করে ইতিহাস লেখেন। ইতিহাস অনুসন্ধান বা জানার নিয়মতান্ত্রিক উপায় অবলম্বন না করলে একজন মানুষ, একটি সমাজ, কোনো দেশ কিংবা জাতি দিগ্‌ভ্রান্ত আর বিভ্রান্ত হতে বাধ্য।

ইতিহাস শব্দটি ব্যবহার করলেই কি ইতিহাস হয়?

ইতিহাস শব্দটি ব্যবহার করলেই কি ইতিহাস হয়? না, হয় না। অনেক সময় মনগড়া কাহিনিকে ইতিহাস বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। অনেক পেশাদার ইতিহাসবিদও নানান স্বার্থের কারণে এমন কাজ করতে পারেন। তাই কোনো একটা তথ্য, ঘটনা কিংবা কাহিনিকে ইতিহাস বলে দাবি করলেই তা ইতিহাস হয়ে যায় না। যথোপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ হাজির করে এবং সেগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারলেই কেবল তা ইতিহাস হয়ে উঠতে পারে।

বিখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. রোমিলা থাপারের গ্রন্থে আছে ইতিহাসের নাম ব্যবহার করা বইয়ের পাতায় ছাপানো যেকোনো বর্ণনা কিংবা কোনো ব্যক্তি ইতিহাস শব্দ ব্যবহার করে কোনো কিছু লিখলেই বা বললেই তা ইতিহাস হয় না। সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি কিংবা মানুষের জীবনে অতীতে ঘটে যাওয়া যেকোনো ঘটনার বর্ণনা তখনই ইতিহাস হবে যখন তা রচনার সময়-

• ইতিহাসের গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে; 

• উৎস হতে প্রাপ্ত তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে; 

• যথাসম্ভব নির্মোহ-নিরপেক্ষতা বজায় রাখা হবে; আর 

• নৈর্ব্যক্তিকতা বজায় রেখে বিজ্ঞানসম্মত ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হবে।

বিভিন্ন উপাদান ও উৎসের ভিত্তিতে ইতিহাস জানতে হয়। ইতিহাস কেবল অতীতে রাজা-বাদশাহদের জীবন- কাহিনি নয়, তাদের সফলতা, যুদ্ধজয় অথবা রাজত্ব বিস্তারের বিবরণ নয়। ইতিহাসের পরিধি অনেক ব্যাপক। হাজারো প্রতিকূলতা জয় করে পৃথিবীর বুকে মানুষের টিকে থাকার যোগ্যতা আর দক্ষতার বিবরণ ইতিহাসের মুখ্য বিষয়।

যেসব উপাদান ও উৎস থেকে ইতিহাস জানার চেষ্টা করা হয়, সেগুলোর সমালোচনামূলকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা খুবই জরুরি। সেগুলোতে কারও কোনো পক্ষপাত বা নিজস্ব মতামত প্রকাশিত হয়েছে কি না, তা যাচাই করে দেখাও অবশ্য কর্তব্য।

চলো দুটো উদাহরণ থেকে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করি। প্রাচীন ভারতের সপ্তম শতকের শাসক হর্ষবর্ধনের সভাকবি বাণভট্ট রচিত 'হর্ষচরিত' গ্রন্থে লেখক শাসকের এমন গুণকীর্তন করেছেন যা সত্যকে অনেক ক্ষেত্রেই ছাড়িয়ে গেছে। এই গুণকীর্তন কিন্তু ইতিহাস নয়। গুণকীর্তনের মধ্য থেকে যেটুকু সত্য আছে তা খুঁজে বের করে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারলেই কেবল তা ইতিহাসে জায়গা পেতে পারে। ইতিহাসের গবেষণাপদ্ধতি অনুসরণ করে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাচাই-বাছাই আর উৎসকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে এই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়।

স্থান ও কালের ভিন্নতায় ইতিহাসের ভিন্নতা

পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের ইতিহাস জানা, বোঝা ও লেখার উপায় অর্থাৎ কলা কৌশল ও পদ্ধতিগত দিকগুলো নিয়ে চলো সংক্ষেপে আলোচনা করে সহজভাবে বিষয়টা বুঝতে চেষ্টা করি।

 স্থান ও কাল নির্ধারণ: ইতিহাস চর্চায় যথাযথভাবে স্থান ও কাল নির্ধারণ করা একজন ইতিহাসবিদের প্রথম কর্তব্য। কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানের ইতিহাস নানান সময়ে নানান রকম হয়। আবার একটি স্থানের ইতিহাসের সঙ্গে অন্য অনেক স্থানের ঘটনা যুক্ত থাকে। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি ব্যাখ্যা করা যায় না। তাই স্থান এবং কাল বিষয়ে ইতিহাসবিদকে সচেতন থাকতে হয়।

দরবারি ইতিহাসচর্চার অসুবিধা বা সমস্যা: ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে উৎসের স্বল্পতা একটি প্রধান সমস্যা। ভারতীয় উপমহাদেশ এবং বাংলার ক্ষেত্রে যেসব লিখিত উৎস পাওয়া যায় তার অধিকাংশই নানান পর্যটক এবং রাজদরবারে বসে লেখা। এসব লেখায় রাজাদের গুণকীর্তন বেশি থাকে। ফলে সাধারণ মানুষের কথা খুব কমই জানা যায়। আর এই রাজা-বাদশাহদের গুণকীর্তনকেই দীর্ঘদিন পর্যন্ত ইতিহাস বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এভাবেই চলেছে ১৮০০ সাল পর্যন্ত। এরপর ব্রিটিশদের হাতে যে ইতিহাসচর্চা হয়েছে, সেখানেও ঔপনিবেশিক স্বার্থের প্রতিফলন দেখা যায়। ইতিহাসের পাঠক ও লেখকদের তাই খুব সাবধানে উৎস নির্বাচন করে নানানভাবে বিশ্লেষণ করে সঠিক ইতিহাস খুঁজে বের করতে হয়।

নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি: ইতিহাসের আরেকটি জরুরি বিষয় হচ্ছে ইতিহাসবিদের নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি। ইতিহাস লিখতে বসে ইতিহাসবিদ যদি কোনো বিশেষ ভাষা, ধর্ম, অঞ্চল, রাজ্য, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির পক্ষ গ্রহণ করে ফেলেন, তবে সেই ইতিহাস আর নিরপেক্ষ থাকে না। সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠে সকল ভাষা, জনপদ, জনজাতি তথা মানুষের কন্ঠস্বর হতে হয় ইতিহাসকে। বিশেষ কোনো গোষ্ঠী, ভাষা, ধর্ম, রাজনীতি বা অর্থনৈতিক গৌরব আর মহিমাকে তুলে ধরার কাজ ইতিহাসের নয়।

সাধারণীকরণের সমস্যা: ইতিহাসে সাধারণীকরণের সমস্যা সবচেয়ে প্রকট। একজন ইতিহাসবিদ বর্তমান পৃথিবীর বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে অতীত পৃথিবীতে মানুষের কর্মকাণ্ড নিয়ে কাজ করেন। বর্তমানের নানান প্রভাব- প্রতিক্রিয়া, ধ্যান-ধারণা আর ভাষা-ধর্ম-রাজনীতি তাঁর অনুসন্ধানকে নানান মাত্রায় প্রভাবিত করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে, প্রাচীন বাংলা কিংবা প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস বলতে গিয়ে অনেক সময় বর্তমান বাংলাদেশ কিংবা বর্তমান ভারতকে বুঝানো হয়। প্রতিটি ধর্মের যে ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক রূপ রয়েছে, তার যথাযথ প্রতিফলন ইতিহাসের গবেষণায় থাকা একান্ত দরকার। ইতিহাসের কোনো বয়ানে ভাষা-ধর্মের দোহাই দিয়ে কোনো মানুষকেই ছোটো করে দেখার কোনো সুযোগ ইতিহাসে নেই। মানুষকে হেয় করে কোনো মন্তব্য করাটা ইতিহাসের সরাসরি ব্যত্যয়।

জেনে রাখা ভালো 

বৈচিত্র্য আর ভিন্নতাকে অস্বীকার করতে গিয়েই আমরা ইতিহাসে সাধারণীকরণের সংকটে পড়ি। এই সংকট থেকে আমাদের অবশ্যই বের হতে হবে। পরিচয়, পেশা, শ্রেণি, শিক্ষা, কাজের ধরন, পোশাক, কথা বলা, ভিন্ন সমাজ-সংস্কৃতি ইত্যাদি কোনো কারণেই কাউকে আলাদা মনে করা ঠিক নয়। কারণ, একটা বিষয় সব সময় মনে রাখতে হবে, ভিন্নতা আছে বলেই আমাদের পৃথিবীটা এত সুন্দর। একবার ভেবে দেখি, পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ প্রজাতির ভিন্ন গাছ না থেকে যদি শুধু এক প্রকারের গাছ থাকত তবে কি পৃথিবী এখনকার মতো এত সুন্দর লাগত? তাই ভিন্নতাকে, বৈচিত্র্যকে আমাদের সব সময় সমান চোখে নিজেদের মতো করেই দেখতে হবে। আমাদের আজকের সমাজে হয়তো এর চর্চা পুরোপুরিভাবে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু আমরা জানি, আমাদের হাত ধরেই বৈচিত্র্যকে বরণ করে নেওয়ার সুন্দর সংস্কৃতি আমাদের দেশে এবং দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পৃথিবীর সবখানে চালু হবে।

 

ভারতীয় উপমহাদেশ, বাংলা অঞ্চল ও বাংলাদেশের প্রাগিতিহাস এবং ইতিহাসের যুগ বা কালবিভাজন

ইতিহাসে যুগ বা কাল বিভাজন

ইতিহাসের যেকোনো আলোচনায় যুগ বা কাল বিভাজন বা নির্ধারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুগ বা কাল বিভাজনের মাধ্যমে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকে একাধিক সময় কাঠামোর মধ্যে বিভক্ত করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশ বা এর পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত বাংলা অঞ্চলের ইতিহাস মোটামুটিভাবে তিনটি যুগে ভাগ করা হয়- প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগ। ইউরোপের ইতিহাসেও এরকম কালবিভাজন রয়েছে। কালবিভাজন করা হয় মূলত এমন কোনো ঐতিহাসিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পরিস্থিতির ভিত্তিতে, যা কি না একটি ভূখণ্ডের বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবনে যুগান্তকারী কোনো পরিবর্তন বা রূপান্তরকে ইঙ্গিত করে। পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের যত অর্জন, পরিবর্তন বা রূপান্তর সেটি সব অঞ্চলে একই সময়ে হয়নি। মানুষের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম প্রভাব বিস্তারকারী ঘটনা ঘটেছে। তাই ইতিহাসের কাল বিভাজনও ভিন্ন ভিন্ন হতে বাধ্য।

লিখিত উৎস বা উপাদান প্রাপ্তি এবং তার পাঠোদ্ধারের ভিত্তিতে 'ঐতিহাসিক যুগ' শুরু হয় বলে ইতিহাসবিদগণ মনে করেন। লিপি আবিষ্কারের পূর্ববর্তী সময় 'প্রাগৈতিহাসিক কাল' বা যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঐতিহাসিক যুগকে কেউ কেউ সেই সময়ের রাজা বা শাসকদের নামে কিংবা তাদের বংশের নামে ডাকেন। কেউ বলেন, রাজাদের বংশের নামে যুগের নাম না হয়ে এমন কোনো নাম হোক, যা সকল মানুষের ইতিহাসের কথা বলবে।

তাই মৌর্য বংশের নামে মৌর্য যুগ, গুপ্ত রাজবংশের নামে গুপ্ত যুগ, পাল রাজবংশের নামে পাল যুগ, সুলতানদের শাসনকালকে সুলতানি আমল, মোগল রাজবংশের শাসনামলকে মোগল যুগ ডাকার পরিবর্তে অনেকেই প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ ও ব্রিটিশ যুগ বা আধুনিক যুগ বলে অভিহিত করে থাকেন।

পাল্টে গেছে, বদলে গেছে মানচিত্র। মানচিত্রের কথা যখন এলোই, চলো প্রাচীন বাংলার একটা মানচিত্র দেখে আসি। এই মানচিত্রটি তোমার বইয়ের ৩২নং পৃষ্ঠায় দেখতে পারো। যিনি মানচিত্র তৈরি করেন তাঁকে মানচিত্রকার বা Cartographer বলা হয়।

এই যে দেশি, বিদেশি, স্থানীয়, বহিরাগত ইত্যাদি শব্দ বইয়ের পাতায় আর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করি, এগুলো দিয়ে আমরা আসলে কী বুঝাই? পৃথিবীর বুকে জাতি-রাষ্ট্র গড়ে ওঠার পূর্বের যেকোনো জনগোষ্ঠীর ইতিহাস বর্ণনায় এই শব্দগুলোর রাজনৈতিক অপব্যবহার সম্পর্কে সতর্ক থাকা দরকার। কেউ দেশি, কেউ বিদেশি, কেউ স্থানীয় আর কেউ বা কেনো বহিরাগত হবেন? কোনো একটি ভূখণ্ডে সকলেই তো হতে পারেন বিভিন্ন সময়ের বসতি স্থাপনকারী।

স্থান ও কালের ভিন্নতায় ইতিহাসের ভিন্নতা হতে বাধ্য। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্ক, চিন্তারও বদল হয়। আর এই বদলে যাওয়াটা ভাষা, শব্দ, সংস্কৃতি, অভ্যাস, জীবনযাপন থেকে শুরু করে সবকিছুর উপরই প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু কথা হলো, এই বদলে যাওয়ার সঙ্গে আমাদের আজকের পাঠের সম্পর্ক কোথায়? আমাদের আজকের পাঠের শিরোনাম 'ইতিহাস জানার উপায়'। শিরোনাম পড়ে নিশ্চয়ই এতক্ষণে ধরে ফেলেছ যে, আদি ঐতিহাসিক কাল, আদি মধ্যযুগ এবং মধ্যযুগের ইতিহাসে বাংলা অঞ্চলে মানুষে-মানুষে সম্পর্ক কেমন ছিল, একে অপরের সঙ্গে বা এক জায়গার মানুষ অন্য জায়গার মানুষের সঙ্গে কীভাবে মিশত এবং এই মিশতে গিয়ে কী কী নতুন ধারণা বা বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত এবং অভ্যস্ত হতো, সেসবের যৌক্তিক এবং গ্রহণযোগ্য বয়ান ইতিহাসে কীভাবে স্থান পেতে পারে তা নিয়েই আমাদের আলাপ।

আর এই আলাপের বড় অংশ জুড়েই রয়েছে বদলে যাওয়া ইতিহাস, সংস্কৃতি, মিশ্রণ এবং নতুন ধারণার উৎপত্তির বয়ান তৈরি হয় কীভাবে? এই বয়ান কারা তৈরি করেন? কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট একটি বয়ান তৈরির পেছনে কোনো অপরাজনীতি কাজ করে? ইতিহাস জানার উপায় নিয়ে আমাদের এই চলমান আলাপের প্রধান কারণ হলো, যেকোনো বিভ্রান্তিকর তথ্য, বাদ দিয়ে সঠিক তথ্য খুঁজে বের করতে শেখা। ইতিহাসে কীভাবে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় তা অনুধাবন করতে পারাও এই আলাপের অন্যতম উদ্দেশ্য।

আমরা নিশ্চই এখন বুঝতে পেরেছি ইতিহাস খুঁজতে হলে আমাদের বেশ কিছু বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে। এখন আমরা যেকোনো একটি ঐতিহাসিক ঘটনা শনাক্ত করব। সেই ঘটনা সংক্রান্ত তথ্য পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব।

 

Content added By
Promotion